বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নিন
প্রিয় পাঠক আপনি হয়তো বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতি সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন কিন্তু কোথাও কোনো তথ্য পাচ্ছেন না। আমরা আজকে এই পোস্টটির মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন পড়া শুরু করা যাক।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক যে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে সেই সম্পর্কে নীচে আলোচনা করব আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। তাই মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য অনুরোধ রইল।
ভূমিকা
বিশ্বের যতগুলো ব-দ্বীপ রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো বাংলাদেশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম ব-দ্বীপ। পদ্মা ,মেঘনা , যমুনা নদীর পশ্চিম উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে একযোগে এ সুবিশাল ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।
এদেশের ভূখণ্ড উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রমশ ঢালু ফলে প্রবাহিত সব নদ-নদী এবং উপনদী শাখা নদী গুলো উত্তর দিক হতে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য
ভূ-প্রাকৃতিক পার্থক্য ও গঠনের দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ
- টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ
- প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বর ভূমি
- সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি।
নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলোঃ
টারশিয়ারি যুগের পাহাড় সমূহ
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, সিলেট ,চট্টগ্রাম ,মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এলাকাগুলো নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত । আনুমানিক টারশিয়ারি যুগের হিমালয় পর্বত উথিত হওয়ার সময় মায়ানমারের দিক হতে আগত গিরিজনিক আলোড়নের ধাক্কায় ভাঁজগ্রস্ত হয়ে এসব পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে তাই এদেরকে টারশিয়ারি যুগের পাহাড় বলা হয় ।
এই পাহাড়গুলো বৈশিষ্ট্য হলো বেলে পাথর প্লেট জাতীয় প্রস্তর এবং কর্দমের সংমিশ্রণে গঠিত ।পাহাড়গুলোর গায়ে ক্ষুদ্র বৃহৎ বৃক্ষরাজি বন এবং অসংখ্য ঝোপ জঙ্গল রয়েছে। তাই সংক্ষেপে বলা হয় যে টারশিয়ারি যুগের হিমালয় পর্বত গঠনের সময় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল বলে এগুলোকে টারশিয়ারি যুগের পাহাড় হয়।
এই পাহাড়ি অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথাঃ
- উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড় সমূহ ও
- দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে পাহাড় সমূহ
উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ
ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার উত্তরাংশ, সিলেট জেলার উত্তর ও পূর্বাংশ এবং মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের দক্ষিণাংশের ছোট বড় বিচ্ছিন্ন পাহাড় গুলো এই অঞ্চলের অন্তর্গত । মৌলভীবাজার হবিগঞ্জের দক্ষিণে পাহাড়গুলোর উচ্চতা ২৪৪ মিটারের বেশি না।
শেরপুর ও ময়মনসিংহে উত্তর সীমানায় কিছু কিছু পাহাড় আছে । উত্তরের পাহাড়গুলোর মধ্যে চিকনাগুল , খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া উল্লেখযোগ্য।মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিন সীমানায় অবস্থিত পাহাড়গুলো কোনোরূপ গিরি শ্রেণী গঠন করেনি। এসব পাহাড়ের তালগুলো খাড়া এবং উপরিভাগ অসমান ।
এদেরকে ত্রিপুরা পাহাড় বলা হয়। শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমানায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের সামান্য বিচ্ছিন্ন অংশ দেখা যায়। এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হ। তাই এখানকার পাহাড়ের ঢালে প্রচুর চা উৎপন্ন হয় ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ চা বাগান এই অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলে আনারস উৎপন্ন হ। এছাড়া এ পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ ও বেত পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস খনিজ তেল, পাথর, কয়লা প্রভৃতি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পাহাড় সমূহ
খাগড়াছড়ি ,রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় এবং চট্টগ্রামের অংশ বিশেষ এই অঞ্চলের অন্তর্গত ।এ পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিংডং (বিজয়) যার উচ্চতা ১২৩১ মিটার। এটা বান্দরবানে অবস্থিত এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যার উচ্চতা ১২৩০ মিটার । এটি অবস্থিত বান্দরবানের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে ।
এসব পাহাড়গুলো বেলে পাথর, শেল দ্বারা গঠিত। এই অঞ্চলের পাহাড়গুলোর মধ্যবর্তী উপত্যকা কর্ণফুলী মাতামুহুরি হালদা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়েছে।
প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বর ভূমি
প্রায় ২৫,০০০ বছর পূর্বে প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বর ভূমি আন্তবরফ গলা পানিতে প্লাবিত হয়ে গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এই অঞ্চলের মাটির রং লাল ও ধূসর।
নিম্নে প্লাইস্টোসিনকালের শেপানসমূহ বা চত্বর ভূমির বর্ণনা দেওয়া হলোঃ
বরেন্দ্রভূমিঃ বরেন্দ্র প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে প্রাচীনতম অঞ্চল বিভাগের। এ বরেন্দ্রভূমির রাজশাহী বিভাগের প্রায় ৯ হাজার ৩২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আছে । প্লাবন সমভূমি থেকে এর উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার। বঙ্গ অববাহিকায় এটি সর্ববৃহৎ প্লাইস্টোসিন যুগের উচ্চভূমি।
এই এলাকার ভূমি অসমতল এবং মাটি লাল। এটি পশ্চিমে মহানন্দা ও পূর্বে করতোয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। গভীর খাতবিশিষ্ট আঁকাবাঁকা ছোট ছোট কয়েকটি স্রোতঃস্বিনী এই অঞ্চলে রয়েছে। এসব স্রোতঃস্বিনী খাড়ি নামে পরিচিত। বরেন্দ্র অঞ্চল কৃষি কাজের জন্য উপযোগী। ধান এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল। এছাড়াও যেসব কৃষি পণ্য এখানে উৎপন্ন হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পাট, ভুট্টা ,পান ইত্যাদি।
মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়ঃ উত্তরের ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত অর্থাৎ ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল ও গাজীপুর অঞ্চল জুড়ে এর অবস্থান। এর মোট আয়তন প্রায় ৪১০৩ বর্গ কিলোমিটার। মাটি কংকর মিশ্রিত ও লাল । প্লাবন সমভূমি থেকে এর পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে উচ্চতা ৬ মিটার কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর দিকের উচ্চতা ৩০ মিটার।
মধুপুর গড়কে অনেক বিশেষজ্ঞ নদী সোপান, আবার কেউ কেউ একে ব-দ্বীপও বলেন। বরেন্দ্রভূমির মতো এখানকার মাটি রং দেখতে লাল এরং কঙ্করময় বলে কৃষি কাজের উপযোগী নয় । এখনও ভূ-ভাগ বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং বাংলাদেশের গজারি বৃক্ষের কেন্দ্র। মধুপুর এলাকায় আনারস ও নানা ধরনের সবজি উৎপন্ন হয় । পানি সেচের মাধ্যমে এই অঞ্চলে কিছু ধানের চাষ হয়।
লালমাই পাহাড়ঃ কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে লাল লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত এটি বিস্তত।লালমাই পাহাড়ের আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গ কিলোমিটার এবং গড় উচ্চতা২১ মিটার । এর মাটির লালচে নুড়ি এবং বালি ও কংকর দ্বারা গঠিত। এ পাহাড়ের পদদেশে আখ , তরমুজ চাষ করা হয়।
সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমি
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি এক অপরূপ সাজে সজ্জিত।কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু আবার কোথাও সমান। আর এরই ধারাবাহিকতায় টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ এবং প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ বা চত্বর ভূমি ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ নদী বিধৌত এক বিশাল সমভূমি । অসংখ্য ছোট বড় নদী বাংলাদেশের সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে আছে। সমতল ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত বলে এ নদীগুলো বন্যার সৃষ্টি করে।
দেশের অধিকাংশ অঞ্চল তখন জলমগ্ন হয়। বছরের পর বছর এভাবে বন্যার সাথে পলিবাহিত পলিমাটি সঞ্চিত হয়ে পলল সমভূমি গঠিত হয়। এর আয়তন প্রায় ১,২্২৬৫ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের উত্তরাংশ থেকে সাগর উপকূলের দিকে সমভূমি ঢাল ক্রমনিম্ন ।
সুন্দরবন অঞ্চল প্রায় সমুদ্র সমতলে অবস্থিত কিন্তু সমুদ্র সমতল থেকে দিনাজপুরের উচ্চতা ৩৭.৫০ মিটার, বগুড়ার উচ্চতা ২০ মিটার ,ময়মনসিংহের উচ্চতা ১৮ মিটার এবং নারায়ণগঞ্জ ও যশোরের উচ্চতা ৮ মিটার।
রংপুর, দিনাজপুর উত্তরাংশ , নোয়াখালী -কুমিল্লার পূর্বাংশ গড়াই মধুমতি অঞ্চলের পশ্চিমাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের উত্তরাংশ দেশের অন্যান্য সমতল ভূমি থেকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ। এসব সমভূমির বিভিন্ন স্থানে বহু নিম্নভূমি ও জলাশয় দেখতে পাওয়া যায়। এর অধিকাংশ পরিত্যক্ত । স্থানীয়ভাবে এগুলোকে বিল ঝিল বা হাওর বলে।
চলনবিল, মাদারীপুর বিল ও সিলেট অঞ্চলের হাওর সমূহ বর্ষার পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে হ্রদের আকার ধারণ করে। সমগ্র সমভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকার স্তর খুব গভীর এবং ভূমির প্রতি অতি উর্বর এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী । তবে এ অঞ্চল সর্বত্র একরূপ নয় বলে একে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।যথাঃ
- কুমিল্লা সমভূমি
- সিলেট অববাহিকা
- পাদদেশীয় পলল সমভূমি
- ব-দ্বীপ অঞ্চলীয় সমভূমি
- সক্রিয় ব-দ্বীপ
- মৃত প্রায় ব-দ্বীপ
লেখক এর মন্তব্য
সম্মানিত পাঠক আশা করি এই পোস্টটি আপনাদের কাছে ভালো লেগেছে । যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে আপনার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেয়ার করা অনুরোধ রইলো।
*ধন্যবাদ*
ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url