যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি আলোচনা কর

 প্রিয় পাঠক এই আর্টিকেলের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আপনারা যদি যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ুন।

যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি আলোচনা কর
যুক্তফ্রন্ট কি, যুক্তফ্রন্ট কয়টি দল নিয়ে গঠিত,যুক্তফ্রন্ট কত দফা নিয়ে গঠিত, যুক্তফ্রন্ট কার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে। এসব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। চলুন পড়া শুরু করা যাক।

ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয় মাইল ফলক হচ্ছে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। যুক্তফ্রন্ট গঠন করা  হয় ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন পূর্ব বাংলার রাজনীতিক  ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সম্মিলিত বিরোধী দল কর্তৃক গঠিত হয় এক শক্তিশালী জোট। মূলত একেই যুক্তফ্রন্ট বলা হয়।

যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি

মুসলিম লীগ ছিল পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। এ দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী , শেরে বাংলা একে ফজলুল হক , এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৩৭ ও ৪৬ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়ার্দীর অবদান ছিল অধিক।

খাজা নাজিমুদ্দিনের অবদান ছিল অনেক নিচে। তথাপি, গণতান্ত্রিক মূলধারার তোয়াক্কা না করে নাজিমুদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী হন। এই ঘটনার প্রতিবাদ করে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক শেষ পর্যন্ত দল ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেন। এই দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ। এবং নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা।

শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই দলের অন্যতম নেতা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল নবগঠিত  আওয়ামীলীগ মুসলিম লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা মুসলিম লীগ ছিল একটি সংগঠিত দল। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক জোটবদ্ধ ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কৌশল গ্রহণ করেন।

তৎকালীন প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনি মোর্চা গঠন করা হয়। যুক্তফ্রন্ট গঠনের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের পূর্ব বাংলার কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চত করা্র যেমন আশ্বাস ছিল, তেমনি ছিল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিশ্রুতি।

১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য চারটি বিরোধী দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে পূর্ব বাংলার বিরোধী রাজনীতিবিদের কয়েকজন মিলে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনের পূর্বে একটি জোট গঠন করেন।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী , শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক , মাওলানা আতাহার আলী এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ এর নেতৃত্বে এ জোট গঠিত হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

যুক্তফ্রন্ট কয়টি দল নিয়ে গঠিত

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এর অন্তর্ভুক্ত দল ছিল ৪ টি। নিম্নে এই দলগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো;
  • কৃষক-শ্রমিক পার্টি;
  • আওয়ামী মুসলিম লীগ;
  • নেজাম-ই-ইসলামি এবং
  • গণতন্ত্রী দল
কৃষক-শ্রমিক পার্টিঃ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক পার্টি গঠিত হয় (১৯৬৩, পূর্বের কৃষক প্রজা পার্টি) কৃষক-শ্রমিক পার্টি ছিল গণতান্ত্রিক একটি দল।

আওয়ামী মুসলিম লীগঃ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল একটি মধ্যপন্থী দল। 
 
নেজাম-ই-ইসলামিঃ মাওলানা আতাহার আলী এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন। এটি ১৯৫৩ সালে গঠিত হয়। নেজাম-ই-ইসলাম ছিল একটি ইসলামিক দল।

গণতন্ত্রী দলঃ হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে বামপন্থী তরুণরা এটি গঠন করে। গণতন্ত্রী দল ছিল বামপন্থী দল। তবে এর যুক্তফ্রন্ট ভুক্ত হওয়া নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

গণতান্ত্রিক,মধ্যপন্থী, ইসলামি ও বামপন্থী দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রকৃতপক্ষে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। ক্ষমতাসীন ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান ও  আধিপত্যর বিরোধিতাই ছিল এর মূল ভিত্তি । শেরে বাংলা একে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ ছিলেন এর মূল ভাগে।

যুক্তফ্রন্ট কয়টি দফা নিয়ে গঠিত হয়

১৯৫৪ সালে নির্বাচনের যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা নিয়ে গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নীতি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ নীতিকে অবমাননা করে কোন আইন প্রণয়ন করা যাবে না এবং ইসলামের সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বকে বজায় রেখে জনগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই নীতিকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের জন্য ২১ দফা দাবি উপস্থাপন করে।

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি বিবরণ নিয়ে আলোচনা করা হলো;

১. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা;

২.জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও হ্রাস;

৩.পাটের ন্যায্য মূল্য প্রধান;

৪.কুটিশিল্পের উন্নতি;

৫.লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন;

৬.বস্তু হারাদের পূর্ণবাসন;

৭.খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা;

৮.খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা;

৯.বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন;

১০.শিক্ষা সংস্কার সাধন;

১১.বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা;

১২.আয়ের সামঞ্জস্য বিধান;

১৩.আয় ব্যয়ের হিসাব;

১৪.কলাকানুন রহিত;

১৫.বিচার বিভাগের স্বাধীনতা;

১৬.বর্তমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা;

১৭.শহীদ মিনার নির্মাণ;

১৮.শহীদ দিবসকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা;

১৯.পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা;

২০.মন্ত্রিসভার পদত্যাগ এবং

২১.উপনির্বাচনের ব্যবস্থা।

২১ দফা দাবি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, যুক্তফ্রন্ট গঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যকে দূর করা। পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত ছিল তৎকালীন সময়ে। যার কারণে পূর্ব পাকিস্তা্নিরা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সকল  সুযোগ-সুবিধা কম পেত।

আর এইসব বিষয়ের  প্রতিকার করার উদ্দেশ্যে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠন করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

১৯৫৪ সালে নির্বাচনের ফলাফল

১৯৫৪ স্বামীর নির্বাচনে মুসলমান আসনের ভোট পড়ে ৩৭.৬০%। তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এবং মহিলা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না আসার কারণে ভোট প্রাপ্তির হার অত্যন্ত কম ছিল। উক্ত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় ১৯৫৪ সালের ১৫ মার্চ তারিখে।১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল সরকারিভাবে উক্ত নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

অমুসলমান আসনের ফলাফলঃ

পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস-২৪ টি আসন

তাফসিল ফেডারেশন-২৭ টি আসন

সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট-১৩ টি আসন

কমিউনিস্ট পার্টি-৪ টি আসন

বৌদ্ধ-২ টি আসন

খ্রিষ্টান-১টি আসন

স্বতন্ত্র-১টি আসন

মোট ৭২ টি আসন

মুসলমান আসনের ফলাফলঃ

যুক্তফ্রন্ট-২১৫ টি আসন

মুসলিম লীগ-৯ টি আসন

খেলাফতে রাব্বানী-১ টি আসন

স্বতন্ত্র-১২ টি আসন

মোট ২৩৭ টি আসন

ত্রিপুরায় ২২ টি আসনের মধ্যে ১৫ টি আসন, নোয়াখালীর ১৩ টি আসনের মধ্যে ১২ টি আসন, চট্টগ্রামে ১৩ টি আসনের মধ্যে ১১টি আসন।মহিলা ৯ টি আসনের মধ্যে ৯ টি আসন লাভ করে যুক্তফ্রন্ট।

এভাবে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২১৫ টি আসন লাভ করে যুক্তফ্রন্ট উক্ত নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়। আর মুসলিম লীগ বিপুল সংখ্যক ভোটে পরাজিত হয়।

লেখকের মন্তব্য

প্রিয় পাঠক এই আর্টিকেলটি পড়ে যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দেবেন।
* ধন্যবাদ*

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url