পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য

প্রিয় সম্মানিত পাঠক এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। নিচে যে সকল তথ্য তুলে ধরা হবে আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক  ও সামরিক বৈষম্য

নিচে পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য সমূহ নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাহলে চলুন পড়া শুরু করা যাক।

ভূমিকা

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বৈষম্য ছিল চরম পর্যায়ে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল বাঙালিরা কিছু মানে না, বোঝে না, তারা কোন কিছু যোগ্য নয়। তাই নেতৃত্ব , কর্তৃত্ব , রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরু দায়িত্ব একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য।

এ উপলব্ধি থেকেই তারা সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করেছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ছিল প্রকট আকারে।

রাজনৈতিক বৈষম্য

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য এবং শোষণ ও শাসন করার জন্য শুরু থেকে রাজনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন শুরু করে । নিম্নে তাদের রাজনৈতিক বৈষম্য গুলো আলোচনা করা হলো;

১. লাহোর প্রস্তাবের দাবি উপেক্ষিতঃ মূল লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ  কূটকৌশল অবলম্বন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

যা বাঙ্গালীদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসী পূর্ব বাংলার অধিবাসী ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব-বাংলার আদিবাসীদের রাজনৈতিক মর্যাদা না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোমুখি করে রাখা হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের করা হয় পাকিস্তানের রাজধানী। এছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও  প্রতিষ্ঠানসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয় । ফলে লাহোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়।

২. পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কূটকৌশলঃ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের উল্লেখ্য থাকলেও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় উল্লেখিত অঞ্চল সমূহ নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়।

এমতাবস্থায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী পূর্ব বাংলার হওয়ার সত্বেও তাদের রাজনৈতিকভাবে মর্যাদা না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখাপেক্ষী করা হয়। এমনকি রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা কৌশল ঠিক করেছিল কেন্দ্রীয়ভাবে সমস্ত রাজনৈতিক কার্যাবলী পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে।

৩. প্রতিনিধিত্বের বৈষম্যের চিত্রঃ জন প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল ব্যাপক আকারের। তৎকালীন সময়ে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ৯৫ জন। আর নয় জন সরকার প্রধানের  মধ্যে তিনজন ছিলেন পূর্ব বাংলার এবং এর মধ্যে নাজিমুদ্দীন ছিলেন উর্দু ভাষী যদিও এক বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তাকে বহিষ্কার করেন।

আর সময়ের হিসেবের ২৪ বছরের মধ্যে ৬ বছর(২৫% সময়) বাংলাদেশের নাগরিকতা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। জেনারেল আইয়ুব খানের  আমলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার হলেও তার শাসনামলে মন্ত্রিসভার মোট ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ২২ জন।

আর এইসব বাঙ্গালীদের মধ্যে কেউ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাননি। তারা বাঙ্গালীদের এমন পদে দিত যেখান থেকে শুধু সান্তনা ছাড়া আর কিছুই জোটত না। বাঙালির জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার পর প্রতিনিধি কম এটা একটি বিশাল বৈষম্য।

৪. সংবিধান প্রণয়নের শাসক শ্রেণীর অনীহাঃ ১৯৪৭ সালের নতুন রাষ্ট্র নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা নিজ নিজ দেশের সংবিধান প্রণয়নের কথা উল্লেখ্য থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয় ১৯৫৬ সালে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি পাকিস্তানের অনিহার কারণে প্রথম সংবিধান প্রণীত হতে নয় বছর সময় লেগেছিল।

পূর্ব বাংলার যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। এ সংবিধানের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিদের পশ্চিমাদের মর্জির উপর নির্ভর করে রাখা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও যুক্ত নির্বাচনের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়।

৫. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবঃ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতি বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। মুসলিম লীগের দেশ পরিচালনা ব্যর্থতা, বাঙালি-অবাঙালি বৈষম্য নীতি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তথা কতিপয় উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা ১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতিত্ব করে।

 মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। কিন্তু ক্ষমতাশীল দল নবগঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ যে নানাভাবে কটাক্ষ করে। তারা চেয়েছিলেন যাদের বাঙ্গালীদের কোন প্রতিনিধিত্ব রাজনীতিতে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তারা আরো বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে।

৬. কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়োগ বৈষম্যঃ তৎকালীন পাকিস্তানি বাঙালিদের প্রত্যেকটি বিভাগেই বৈষম্যর শিকার হতে হয়েছিল। যেমন বেসামরিক উচ্চপদ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাঙালি প্রতিনিধিত্ব এক দিকের যেমন কম ছিল, অন্যদিকে তেমনি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও ক্ষমতা সীমিত ছিল।

১৯৬৬ সালের এক হিসাব থেকে এ বৈষম্যর চিত্র আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ১৩ টি কর্পোরেশনের মধ্যে একটি মাত্র চেয়ারম্যান ছিলেন বাঙালি। অন্যদিকে ১৯৬৩ সালের এক হিসেবে জানা যায় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাত্র ৩.৪% বাঙালি নিযুক্ত ছিলেন।

সামরিক বৈষম্য

পাকিস্তান শাসনামালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে দিন দিন পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশীল হয় , অন্য দিকে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। নিম্নে পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সাময়িক বৈষম্য আলোচনা করা হলো;

১ সুশৃঙ্খল সামরিক আমলাতন্ত্রঃ পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এক  সুশৃঙ্খল আমলাগোষ্ঠী লাভ করে। ব্রিটিশ আমলে এ আমলাগোষ্ঠীই ছিল প্রশাসনের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।

দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাতা থেকে শুরু করে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল আমলাগোষ্ঠী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ আমলা শ্রেণী প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং তারা সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

২ পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসঃ ১৯৪৭ সালে মুসলমান আইসিএস অফিসারদের এক-তৃতীয়অংশ ছিলেন পাঞ্জাবি, অবশিষ্টরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত বাঙালির রিফুজি মুসলমান। আর এদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিস।

তারা পাকিস্তান প্রশাসনের উচ্চতম পদগুলো দখল করেন। স্বভাবতই স্বাধীনতা সূচনালগ্নেই পাকিস্তান প্রশাসনে অবাঙালি মুসলমানদের একচেটিয়া অধিপত্য কায়েম করে। ১৯৪৭ এরপর ১৫ জন প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সদস্যকে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পদোন্নতি দেওয়া হয়।

এখানেও পশ্চিম পাকিস্তানে আমলাদের প্রভাব ক্ষুন্ন থাকে। এখানে ১৫ জনের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৪ জন। বাঙালির পরবর্তীতে বাঙ্গালীদের প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে।

৩ রাজনীতিতে প্রভাবঃ আইয়ুব খান ছিলেন একজন সরকারি আমলা। তিনি ক্ষমতা দখল করে প্রকাশ্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রকৃত গণতান্ত্রিক হত্যা করেন। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে।

৪ নৌবাহিনীঃ নৌবাহিনীতে ১৯% টেকনিক্যাল লোক ছিল বাঙালি এবং বাকি ৮১% ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। নন টেকনিক্যাল লোকের মধ্যে বাঙালি ছিলেন ৯ %।

৫ প্রতিরক্ষা বিভাগে প্রভাব বিস্তারঃ প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল শাখার সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিরক্ষা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গুলোও সেখানে ছিল। প্রতিরক্ষা বিভাগের নাম লেখাতেই চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৬ থেকে ২০ বা ২২ বছর মাতৃভূমি ছেড়ে হাজার মাইল দূরে যাওয়ার আগ্রহ খুব কম পূর্ব পাকিস্তানে ছিল।

আবার ইচ্ছা থাকলেও প্রতিরক্ষা সার্ভিসে নিয়োগ লাভ বাঙ্গালীদের জন্য ছিল বেশ কঠিন। এমনকি জোয়ান পদে নিয়োগের জন্য যে দৈহিক মাপ ও গঠন নির্ধারণ করা হয়েছিল তা খুব কম বাঙালির ছিল। ফলে প্রতিরক্ষা বিভাগে একমাত্র প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আমলারা। তারা দেশের ভালো মন্দের কথা না ভেবে ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নিত।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে , পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৩ বছরে সামরিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য বাঙালিরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদেশি আগ্রাসন থেকে নিরাপদ রাখা হতো। আর এ বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

লেখকের মন্তব্য

সম্মানিত পাঠক এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দিবেন।
* ধন্যবাদ*

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url