রাষ্ট্রের উৎপত্তি ,প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ,প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ হয়তো আপনি অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন কিন্তু কোন তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না। তাহলেএই আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য। 
রাষ্ট্রের উৎপত্তি ,প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ
এছাড়া রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।তাহলে চলুন পড়া শুরু করা যাক।

ভূমিকা

রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র। তাই এরিস্টটল রাষ্ট্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনার অবকাশ পেয়েছেন।এরিস্টটল তাঁর পলিটিক্স গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারনা ব্যক্ত করেছেন।

রাষ্ট্রের কাকে বলে?

রাষ্ট্র হচ্ছে কোন উত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানবের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা। এরিস্টটল রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করেছেন।এরিস্টটল  রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন , সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ।এরিস্টটল বলেন, যে রাষ্ট্রে বসবাস করে না সে পশু না হয় দেবতা।

একাধিক গ্রাম বা অনুরুপ  জনপদসমূহ নিয়ে রাষ্ট্র সৃষ্টি।মানুষের স্বভাব হচ্ছে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের বসবাস করা।এমন মানুষ যদি পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রহীন তাহলে তাকে আমরা সে মানুষকে হয় অধমের অধম,নয়তো উত্তমের উত্তম, অমানুষ কিংবা অতিমানুষ বলে গণ্য করব।

রাষ্ট্র হলো কতিপয় পরিবার ও গ্রামের পরিবারের সমষ্টি,যার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ ও স্বনির্ভর জীবন।
রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যেখানে সংগঠিত জনসমষ্টি কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডে স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারের অধীনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে।

রষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের মতবাদ

এরিস্টটল রাষ্ট্রকে মানবীয় প্রতিষ্ট্রান বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে,রাষ্ট্র মানব জীবনের চরম পরিণতি।রাষ্ট্র ছাড়া মানব জীবন  অসম্পূর্ণ।একমাত্র রাষ্ট্রে বসবাসের মাধ্যমে মানব জীবন উন্নত হয়েছে।এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কেবল জনগণের জীবন রক্ষা নয় বরং সুন্দর ও মহত্তর জীবন গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করাই এর প্রকৃত উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে এরিস্টটলের মতামত নিম্নরুপঃ

মানুষের সহজাত প্রবণতা  থেকে রাষ্ট্রের সৃষ্টিঃএরিস্টটলের মতে মানুষের সহজাত প্রবণতা থেকে রষ্ট্রের  সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতে মানুষ মূলত রাজনৈতিক জীব এবং এটা প্রাকৃতিক বিধান যে, রাজনৈতিক জীব হিসেবে সে রাষ্ট্রের সদস্য না হয়ে জীবনযাপন করতে পারবে না। যদি এমন কোন লোক পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায় না, সে পশু না হয় দেবতা।

রাষ্ট্রের স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানঃএরিস্টটল মনে করেন যে নিত্যান্ত স্বাভাবিক নিয়মে রাষ্ট্রের  উৎপত্তি হয়েছে। রাষ্ট্র প্রকৃতির অবদান। রাষ্ট্র প্রাকৃতির সৃষ্টি এবং প্রাকৃতিগতভাবেই রাজনৈতিক জীব। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে,প্রাকৃতিক স্বাভাবিক নিয়মে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।

 রাষ্ট্র নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রঃ সমাজের সকল মানুষ একই গুণ বা প্রতিভার অধিকারী নয়। মানব সমাজে কেউ সবল আবার কেউ দুর্বল এ অবস্থায় সমাজের সবলেরা দুর্বলের ওপর সর্বদা তাদের প্রভাব ও অধিপত্য  বজায় রেখে চলে। যার ফলে দুর্বলেরা সবল কর্তৃক সব সময় শাসিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব ছাড়া কখনই দুর্বলেরা নিজেদের আত্মরক্ষা করতে পারবে না।

সামাজিক চুক্তির ফলঃএরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র সামাজিক চুক্তির ফল। তাঁর মতে মানুষের রয়েছে অগণিত চাহির। এই অগণিত চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের প্রয়োজন অপরের সহযোগিতা। তাই মানব জীবনের নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য এবং তাদের চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ একসাথে বসবাস করে এভাবে আস্তে আস্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র সৃষ্টি হয় । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের অধিবাসীরা নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র করে তোলে।

উন্নত জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষাঃএরিস্টটলের মতে, প্রতিটি মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে চায় । চায় সুন্দর ও উন্নত জীবন-যাপন করতে । এই  সহজাত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য মানুষ একসাথে বসবাস করে রাষ্ট্র গঠন করে। তার মতে রাষ্ট্র যেন একটি পাখির বাসা, খাঁচা নয়।

পরস্পর সম্প্রসারণে ফলে রাষ্ট্রের সৃষ্টিঃএরিস্টটলের মনে করেন, মানুষ একাকী বাস করতে পারে না ফলে পরিবার গঠিত হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজন সীমিত ছিল, চাহিদা কম ছিল ততদিন পর্যন্ত পরিবার মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। পরবর্তীতে পরিবার সম্প্রসারিত হয়ে গ্রামের সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে গ্রামগুলো সম্প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি

এরিস্টটল তার (The Politics) গ্রন্থে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এরিস্টোটলের মতে, রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ব্যক্তির বিরোধিতা থাকতে পারে না। কারণ একমাত্র রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ব্যাক্তি তার জীবনের পরমতম লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়। নিম্নে সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
 
রাষ্ট্র সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানঃ সমাজের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হল রাষ্ট্র। সমাজে এর চেয়ে বড় আর কোন প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করা যায় না। মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে তাগিদে এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছেন। একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান তাই এর মাধ্যমে মানব জীবনের পূর্ণতা আনা সম্ভব। রাষ্ট্র কেবল একটি সমিতি নয়,এটি হলো একটি সর্বোচ্চ সমিতি।

রাষ্ট্র বিবর্তনের ফলঃ এরিস্টোটল মনে করেন যে, রাষ্ট্র হলো বিবর্তনের ফল। তাঁর মতে রাষ্ট্র একদিন তৈরি হয়নি আধুনিককালে রাষ্ট্র রাষ্ট্রচিন্তাবিদরাও এরিস্টটলের এ বিবর্তনবাদী চেতনার সাথে একমত পোষণ করেছেন। 

তিনি সামাজিক চুক্তি বা অন্য কোন পদ্ধতিতে রাষ্ট্র সৃষ্টির পক্ষে একমাত্র প্রকাশ করেননি। তিনি মনে করেন সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিকাশ সাধিত হয়েছে। একটি বৃক্ষ যেমন দিনে দিনে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে মহীরুহে পরিণত হয়, তেমনি রাষ্ট্র দিনে দিনে বিকাশিত হয়ে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাভাবিক সংগঠনঃ এরিস্টোটল রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক সংগঠন বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে মানব প্রকৃতির মাঝেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরাজমান। সুন্দর সুখী ও সমৃদ্ধশীল জীবন যাপনের লক্ষ্যেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের বসবাসের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গুনগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয় ।তাই এরিস্টটল বলেছেন ,যে সমাজে বাস করে না , সে পশু না হয় দেবতা।

স্বয়ংসম্পূর্ণঃ এরিস্টোটল মনে করেন , রাষ্ট্র একটি খাঁটি ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থা । এ সংস্থা  বাহিরে কোন ক্রিয়াশীল সংস্থা হতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এটি অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হয় না এর নিজস্ব মৌলিক ও স্বতন্ত্র ভাবধারা রয়েছে ।

রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

রাষ্ট্র গঠনের কতিপয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। রাষ্ট্রের অধিবাসীদের কল্যাণ সাধনের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে । তাই রাষ্ট্রের কতগুলো উদ্দেশ্য রয়েছে। নিম্নে এ উদ্দেশ্য গুলো আলোচনা করা হলো ;

মানুষের কল্যাণ সাধনঃএরিস্টটলের মতে , রাষ্ট্র মানব জীবনের সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনের জন্য নিয়োজিত সংস্থা। মানুষ নিজেদের কল্যাণের রাষ্ট্র গঠন করেছেন। শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনেই নয় বরং সামগ্রিকভাবে কল্যাণ সাধনের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি। রাষ্ট্র সর্বদা মানুষের কল্যাণকর দিক গুলো চিন্তা ভাবনা করেন।

মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাঃ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চয়ত করার জন্য রাষ্ট্রে বসবাস করে। মানুষ সমাজের পাশবিক শক্তির থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা করার জন্য রাষ্ট্রে বসবাস করে। রাষ্ট্র হচ্ছে মানব জীবনের বহু প্রতীক্ষিত একটি  প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ নিজেদের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে।

নাগরিকদের শিক্ষিত করে তোলাঃ এরিস্টটল মনে করেন, রাষ্ট্র একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি জীবনের যাবতীয় পূর্ণতা বিধানের জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন রাষ্ট্র তার যথার্থ ব্যবস্থা করে থাকে।

মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে সহায়তা করেঃএরিস্টটলের মতে মানুষের জীবনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা হচ্ছে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য । রাষ্ট্র ছাড়া মানব জীবনের সকল দিক স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা সম্ভব না।রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান যেটির মাধ্যমে মানুষের জীবনের পূর্ণতা পায়।

নৈতিক মান উন্নত করাঃ রাষ্ট্র নাগরিকদের নৈতিক জীবনের মানকে উন্নত করার পক্ষে কাজ করে। এরিস্টটল মনে করেন, রাষ্ট্রের নাগরিকরা নৈতিকতা সম্পন্ন না হলে সে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ফিরে আনা সম্ভব না।

নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলাঃ এরিস্টটলের মতে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে  সচেতন করে। রাষ্ট্রে  বসবাসের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। এছাড়া রাষ্ট্রের প্রতি তাদের যেসব কর্তব্য সে সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করতে পারে । এর মাধ্যমে নাগরিকরা নিজেদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

যে পরিশেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল আসলে সমাজের মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য তাঁর রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ প্রণয়ন করেছেন । তিনি আসলে মানব জীবনের সুকুমার বৃত্তিগুলো রাষ্ট্রের মাধ্যমে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তিনি মানবজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।

লেখকের মন্তব্য 

প্রিয় সম্মানিত পাঠক এই আর্টিকেলটি আপনাদের কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দিবেন।
 ''ধন্যবাদ''

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url