ভাষা আন্দোলন কি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এর তাৎপর্য লেখ

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় সম্মানিত পাঠক এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে আমরা ভাষা আন্দোলন কি বা ভাষা আন্দোলন বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করি আর্টিকেলটি আপনারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়বেন।
ভাষা আন্দোলন কি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এর তাৎপর্য লেখ
এছাড়াও এই আর্টিকেলের মধ্যেমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এর তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।

ভূমিকা

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের মূলে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে। পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপই ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।

ভাষা আন্দোলন

পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ফলে বাঙালি জনগণ বিশেষ করে ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায় বাংলা ভাষা; সাহিত্য ও সংস্কৃতির রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটাই 'ভাষা আন্দোলন' নামে খ্যাত। 

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত প্রতিবাদ দিবসে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে এবং রক্ত ঝরার মাধ্যমে এ আন্দোলন বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে, যা ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির রূপ নেয়।

সাবেক পাকিস্তানি গণপরিষদের বাংলা ভাষার বিরোধী সিদ্ধান্ত ও সরকারের দলের বাংলা ভাষা বিরোধি কার্যকলাপের ফলে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সাল থেকে যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৫২ সালে।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এ ঘোষণাই ভাষা আন্দোলনের রূপ নেয় এবং চারিদিকে তীব্র প্রতিবাদে ঝড় উঠে। ১৯৫০ সালের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং ক্ষমতা বিকেন্দীকরণের দাবি না থাকায় বাঙালি জনমত এর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তা প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আবারও ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা সমগ্র দেশব্যাপী ধর্মঘট আহবান করে এবং ধর্মঘটের প্রতি বিপুর পরিমাণ জনসমর্থন পাওয়া যায়।

এই অবস্থায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করলে তখনকার সরকার বাসা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য এদেশের ছাত্র সমাজকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভয় দেখায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।


কিন্তু বাংলার নির্ভক ও দামাল ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে পড়ে। পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন থেকে মিছিল বের হয়। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হতে না হতেই মিছিলের উপর পাক পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হয়।

ফলে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন সালাম, জব্বার, বরকত, রফিকসহ আরো নাম না জানা অনেকে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এর বর্বরোচিত  হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সাড়া সমগ্র বাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে এবং তারা এক প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তোলে।

এর ফলে শুরু হয় মাতৃভাষার অধিকার আদায় ও বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা সংগ্রাম। এই আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তান সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এভাবে রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা মর্যাদা লাভ করে। যা ১৯৫৬ সালের সংবিধানের বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে বিখ্যাত। সারা বিশ্বে ভাষার জন্য বাঙ্গালীদের মতো আর কোন জাতিকে এতো রক্ত দিতে হয়নি। এই জন্যই বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে।

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের যেমন অগ্রগামী আন্দোলন, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এটি একটি মাইলফলক।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ বাংলার অগণিত দামাল ছেলের বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করেছিল।

তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মাতৃভাষা বাংলার অধিকার। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রীর জনাব এ. এইচ. এস.কে সাদেক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এর ৩১ তম সম্মেলন মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এটা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। বিশ্বের আদর্শ সংস্থা হিসেবে তাই এটিকে বিভিন্ন মহল সাধুবাদ জানায়। 

মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক হৃদয় বিদারক অথচ গৌরবময় দিন। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একদিন রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ। তাই এই দিনের গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। নিচে মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিনঃ বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বাঙালি জাতির অগ্রণী ভূমিকায় এ ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার এটা আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

২. বহির্বিশ্বে বাঙালি জাতির মর্যাদা বৃদ্ধিঃ অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের মতো মহান শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। বিশ্ববাসী জানতে পারে বাঙালির গৌরব গাঁথা, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ৫২ ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের ভাষা শহীদদের।

৩. নিজস্ব অস্তিত্বের গুরুত্বঃ একই মাতৃভাষায় যারা কথা বলে তাদের একটি নিজস্ব পরিচিতি বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। তারা নিজেদেরকে অন্যান্য ভাষার লোকদের সাথে সহজে পৃথক করতে পারে। মাতৃভাষা দিবসের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ ভাষার যেমন মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, তেমনি ভাষা কেন্দ্রিক তাদের নিজস্ব অস্তিত্বকে গুরুত্ব দিয়েছে।


৪. প্রত্যেক ভাষার ঐতিহ্য রক্ষাঃ মাতৃভাষা প্রত্যেকের নিকট অত্যন্ত গৌরবের। প্রত্যেক ভাষাকে নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে একজন অপরজনের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে অন্য কোন ভাষার সাথে তা পারেনা। তাই মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে প্রত্যেক ভাষার ঐতিহ্য রক্ষার প্রতি  গুরুত্ব দেওয়া হয়।

৫. জাতিসত্তা ও ভাষাসত্তার চরম বিকাশঃ মাতৃভাষা দিবস পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্র জাতীয় ও তাদের ভাষা গোষ্ঠীকে আরোও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এই দিবসের মাধ্যমে স্বীকৃতি হয়েছে বাঙালি জাতির জাতিসত্তা বা ভাষাসত্তা আর সার্বভৌমত্বের চরম বিকাশ।

অতএব,১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্মরণে পরবর্তীতে ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি "শহীদ দিবস" হিসেবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়ে আসছে। বাঙালির আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর সাধারণ সম্মেলনে সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ইউনেস্কোর সকল সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে।

এ স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর নিকট ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদান ও আত্মত্যাগের ইতিহাস উপস্থাপিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও উন্নতিকে ত্বরান্বিত করে। ২১ ফেব্রুয়ারিরর চেতনা বাঙালি জাতিকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।

শেষ কথা

প্রিয় সম্মানিত পাঠক আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দিবেন।
* ধন্যবাদ*

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url