ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে জেনে নিন

প্রিয় সম্মানিত পাঠক হয়তো আপনি ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন কিন্তু কোথাও কোন তথ্য খুঁজে পাচ্ছেন না । আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে ভিটামিনের কারণে যে সকল রোগ হয়ে থাকে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ সম্পর্কে জেনে নিন
যেহেতু শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। তাই কোন খাদ্যের মধ্যে কোন ভিটামিন রয়েছে। এবং সে ভিটামিন গুলোর কাজ কি। সে সম্পর্কে মানসম্মত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাহলে চলুন পড়া শুরু করা যাক।

ভূমিকা       

ভিটামিন প্রাণীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শরীর সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন হচ্ছে জৈব প্রকৃতির যৌগিক পদার্থ। আমরা যদি প্রতিদিন প্রচুর শাকসবজি সহ মানসম্মত খাবার খাই তাহলে আমাদের দৈনন্দিন খাবার থেকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন পেয়ে যেতে পারি। এর ফলে ভিটামিনের অভাব জনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ

ভিটামিনের নাম রাসায়নিক নাম দ্রবনীয় রোগের নাম
ভিটামিন A রেটিনল স্নেহ পদার্থে রাতকানা,জেরপথালমিয়া
ভিটামিন B1 থায়ামিন পানি বেরিবেরি
ভিটামিন B2 রাইবোফ্ল্যাভিন পানি Ariboflavinosis
ভিটামিন B5 নিয়াসিন বা নিকোটিনিক এসিড পানি Paresthesia
ভিটামিন B6 পাইরিডক্সিন পানি রক্তশূন্যতা
ভিটামিন B12 কোবালামিন বা সায়ানোকোবালামিন পানি Megaloblastic anaemia
ভিটামিন C অ্যাসকরবিক এসিড পানি স্কার্ভি
ভিটামিন D Ergocalciferol স্নেহ পদার্থে Rickets
ভিটামিন E Tocopherol,Tocotrienol স্নেহ পদার্থে Deficiency is very rare,mild hemolytic anemia in newborn
ভিটামিন K ফাইলোকুইনন স্নেহ পদার্থে Bleeding diathesis

স্নেহে দ্রবণীয় ভিটামিন

ভিটামিন A, ভিটামিন D, ভিটামিন E ও ভিটামিন K।

ভিটামিন A

ভিটামিন 'এ' আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ভিটামিন 'এ' হলো স্নেহে বা চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। ভিটামিন 'এ' এর রাসায়নিক নাম হলো "রেটিনাল"। মানব দেহের জন্য ভিটামিন 'এ' খাদ্য খুবই প্রয়োজনীয়।


খাবারের সাথে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের জন্য দিনে ৯০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন 'এ' থাকা উচিত। এবং একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর জন্য ৭০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন 'এ' থাকা দরকার। ভিটামিন 'এ' আমাদের দৃষ্টিশক্তি, প্রজনন, শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং ত্বকের উন্নতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ভিটামিন এ এর উৎসঃ ভিটামিন A এর উৎস দুটি।

১. প্রাণিজ উৎসঃ ডিম, গরুর দু্‌ধ, মাখন, ছানা, দই, ঘি, যকৃত ও বিভিন্ন তেল সমৃদ্ধ মাছ, বিশেষ করে কড মাছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন A পাওয়া যায়।

২. উদ্ভিজ্জ উৎসঃ উদ্ভিজ্জ উৎসের মধ্যে ক্যারোটিন সমৃদ্ধ শাকসবজি, যেমন-লাল শাক, কচু শাক, পুইশাক, পাট শাক, কলমি শাক, ডাটা শাক, পুদিনা পাতা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স , বাঁধাকপি , মটরশুঁটি এবং বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন; আম, পাকা পেঁপে ,কাঁঠাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন A রয়েছে।

ভিটামিন A এর কাজঃ ভিটামিন A যে সব কাজগুলো করে সেগুলো হলোঃ

১. দেহের স্বাভাবিক গঠন এবং বর্ধন সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ হওয়ার কাজ নিশ্চিত করে।

২ দেহের বিভিন্ন আবরণী কলা যেমন; ত্বক, চোখের কর্নিয়া ইত্যাদিকে স্বাভাবিক ও সজীব রাখে।

৩ হাড় এবং দাঁতের গঠন এবং দাঁতের মাড়ি সুস্থ রাখে।

৪ দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।

৫ দেহের রোগ সংক্রামক প্রতিরোধ করে।

ভিটামিন A এর অভাবজনিত রোগ 

ভিটামিন A এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। এর অভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে চোখের কর্নিয়ায় আলসার হতে পারে। ফলে এই অবস্থাকে জেরপথ্যালমিয়া রোগ বলা হয়। এই রোগ হলে মানুষ স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে।


ভিটামিন A এর অভাবে দেহের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে বাধা করতে হয়। অনেক সময় ঘা, সর্দি , কাশি , গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। ভিটামিন A এর অভাবে লোমকূপের গোড়ায় ছোট ছোট গুটির সৃষ্টি হতে পারে।

ভিটামিন D

ভিটামিন D একমাত্র প্রাণিজ উৎসাহ থেকে পাওয়া যায়। এই  ভিটামিন D সূর্যলোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে মানুষের ত্বকে সংশ্লেষিত হয়। ডিমের কুকুর, দুধ এবং মাখন ভিটামিন D এর প্রধান উৎস। বাঁধাকপি, যকৃৎ এবং তেলসমৃদ্ধ মাছে  ভিটামিন D পাওয়া যায়। ভিটামিন D শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সাহায্য করে, যা হাড় তৈরি কাজে লাগে।

 ভিটামিন D এর অভাবজানিতো রোগ

ভিটামিন D এর অভাবে শিশুদের রিকেট রোগ হতে পারে। দৈনিক চাহিদা থেকে বেশি পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহণ করলে শরীর ক্ষতি হয়। এর ফলে অধিক ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষিত হওয়ায় রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যে কারণে বৃক্ক বা কিডনি, হৃদপিণ্ড, ধমনী ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম জমা হতে থাকে।

ভিটামিন E

সব রকম উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল বিশেষ করে পাম তেল ভিটামিন E এর ভালো উৎস। প্রায় সব খাবারেই কম বেশি ভিটামিন ই আছে। তাছাড়া শস্যদানা তেল, তুলার বীজের তেল, সূর্যমুখী বীজের তেল, লেটুস পাতা ইত্যাদিতে ভিটামিন E পাওয়া যায়।

মানুষের শরীরে ভিটামিন E হলো এন্টি-অক্সিডেন্ট, যেটি ধমনীতে চর্বি জমা রোধ করে এবং সুস্থ ত্বক বজায় রাখে। এছাড়া ভিটামিন E কোষ গঠনে সাহায্য করে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বন্ধ্যাত্ব দূর করে।

ভিটামিন E এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন E এর অভাবে জরায়ুর মধ্যে ভ্রূণের মৃত্যু হতে পারে। দৈনিক সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে এই ভিটামিনের বিশেষ অভাব হয় না।

ভিটামিন K

ভিটামিন K চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। ভিটামিন K এর ফলে মানবদেহে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ভিটামিন কে এর অভাবে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ে। হাড়ের দুর্বলতা বাড়ে। হাড়ে খনিজের স্বল্পতা দেখা দেয়। ভিটামিন কে এর অভাবে হৃদরোগ, দাঁত ক্ষয় হয়ে থাকে। রক্তপাত ও রক্ত জমাট বাধার সমস্যা দেখা দেয়।

পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন 

ভিটামিন B কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন C ।

ভিটামিন B কমপ্লেক্স

পানিতে দ্রবণীয় ১২ ভিটামিন B রয়েছে। ভিটামিনের এই গুচ্ছকে ভিটামিন B কমপ্লেক্স বলা হয়। দেহে স্বাভাবিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য খাবারের ভিটামিন B কমপ্লেক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেহের বৃদ্ধি, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কাজ, দেহকোষে বিপাকীয় কাজ, প্রজনন ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য খাদ্যে ভিটামিন B কমপ্লেক্স উপস্থিত থাকা অতি আবশ্যক।

ভিটামিন B1 

ভিটামিন B1 এর রাসায়নিক নাম থায়ামিন।

ভিটামিন B1 এর উৎসঃ ভিটামিন B1 এর উৎস দুইটি। যেমন উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণিজ উৎস।

১. প্রাণিজ উৎসঃ প্রাণিজ উৎসের মধ্যে রয়েছে যকৃত, মাছ, দুধ, ডিম ইত্যাদি।

২. উদ্ভিজ্জ উৎসঃ উদ্ভিজ্জ উৎসের মধ্যে রয়েছে ঢেঁকিছাটা চাল, আটা, ডাল, তেল বীজ, বাদাম, টাটকা ফল ও সবজি ইত্যাদি।


ভিটামিন B1 এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন B1 এর এর অভাবে দেহের থায়ামিনের চরম অভাবে বেরিবেরি রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর অভাবে স্নায়ুর দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি, খাওয়ার অরুচি, ওজনহীনতা ইত্যাদির সমস্যা দেখা দেয়।

ভিটামিন B2

ভিটামিন B2 এর রাসায়নিক নাম রাইবোফ্ল্যাভিন।

ভিটামিন B2 এর উৎসঃযকৃৎ, দুধ, ডিম, সবুজ শাক-সবজি,গাছের কচি ডগা, অঙ্কূরিত বীজ ইত্যাদি।

ভিটামিন B2 এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন B2 এর অভাবে ঠোঁটের দুইপাশে ফাটল দেখা যায়। মুখে ও জিভে ঘা হয়। ত্বক খসখসে হয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এর অভাবে তীব্র আলোতে চোখ খুলতে অসুবিধা হয়।

ভিটামিন B5

ভিটামিন B5 এর রাসায়নিক নাম নিয়াসিন বা নিকোটিনিক এসিড।

ভিটামিন B5 এর উৎসঃ মাংস,যকৃৎ,আটা,ডাল,বাদাম,তেলবীজ, ছোলা, শাক-সবজি ইত্যাদি।

ভিটামিন B5 এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন B5 এর অভাবে পেলেগ্রা রোগ হয়। পেলেগ্রা রোগে ত্বকে রঞ্জক পদার্থ জমতে শুরু হয় এবং সূর্যের আলোয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলের ত্বকে লালচে দাগ পড়ে এবং ত্বক খসখসে হয়ে যায়। এছাড়া  রঞ্জক পদার্থ জমে জিভের এট্রোফি হয়।

ভিটামিন B6

ভিটামিন B6 এর রাসায়নিক নাম পিরিডক্সিন।

ভিটামিন B6 এর উৎসঃ চাল,আটা,মাছ,মাংস,শাক-সবজি,ছোলা, ছত্রাক,বৃক্ক, ডিমের কুসুম ইত্যাদি।

ভিটামিন B6 এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন B6 এর এর অভাবে খাওয়ায় অরুচি, বমিভাব এবং অ্যানিমিয়া রোগ দেখা দেয়।

ভিটামিন B12

ভিটামিন B12 এর রাসায়নিক নাম কোবালামিন বা সায়ানোকোবালামিন।

ভিটামিন B12 এর উৎসঃ যকৃৎ, দুধ,মাছ, মাংস,ডিম,পনির,বৃক্ক ইত্যাদি।

ভিটামিন B12 এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন B12 এর অভাবে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। ফলে স্নায়ুতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটে।

ভিটামিন C

ভিটামিন C এর রাসায়নিক নাম অ্যাসকরবিক এসিড। ভিটামিন C টাটকা শাকসবজি এবং টাটকা ফলে পাওয়া যায়। শাকসবজির মধ্যে মুলাশাক, লেটুসপাতা, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, কাঁচামরিচ, ফুলকপি, করলা ইত্যাদিতে ভিটামিন C রয়েছে।

ফলের মধ্যে আমলকি, লেবু, কমলালেবু, টমেটো, আনারস, পেয়ারা ইত্যাদি ভিটামিন সি এর উৎস। শুকনোফল ও বীজে এবং টিনজাত খাদ্যে এই ভিটামিন সি থাকে না।

ভিটামিন C এর কাজ

১. ত্বক,হাড়, দাত ইত্যাদির কোষসমূহকে পরস্পরের সাথে জোড়া লাগিয়ে মজবুত গাঁথুনি তৈরি করে।

২. শরীরের ক্ষত পূর্ণগঠনের কাজে সাহায্য করে।

৩. দাঁত ও মাড়ি শক্ত রাখে।

৪. স্নেহ, আমিষ ও অ্যামাইনো এসিডের বিপাকীয় কাজে ভিটামিন C গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৫. ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল রাখে।

৬. রোগ প্রতিরোধ করে।

ভিটামিন C-এর অভাবজনিত রোগ

ভিটামিন C-এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। অস্থির গঠন শক্ত ও মজবুত হতে পারে না। ত্বকের ঘা হয়, ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। দাঁতের মাড়ি ফুলে দাঁতের ইনামেল উঠে যায়। দাঁত দুর্বল হয়ে অকালে ঝরে পড়ে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে সহজে ঠান্ডা লাগে।

শেষ কথা

প্রিয় সম্মানিত পাঠক আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা ভিটামিন সম্পর্কে প্রোপার তথ্য পেয়েছেন। এই আর্টিকেলটি আপনাদের কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দিবেন।
* ধন্যবাদ*


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url