মে দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে জেনে নিন

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় সম্মানিত পাঠক আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে মে দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাহলে এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে অনুরোধ রইল।
মে দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে জেনে নিন
ধনতান্ত্রিক শোষণের যাঁতাকলে দুনিয়ার মেহনতি মানুষ আজও পিষ্ট হচ্ছে। মে দিবস শ্রমিকের শ্রমক্লান্ত জীবনে নতুন পথ নির্দেশ করে থাকে। তাহলে চলুন মে দিবস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

ভূমিকা

বিশ্বের মেহনতি মানুষের কাছে মে দিবস একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রতিবছর এই দিনে সব শ্রমিক মিলে একটি মহান চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়। শ্রমিকের শ্রম ও ঘামের ন্যায্য প্রাপ্তি ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা লড়াইয়ে দিবস একটি আপোষহীন সংগ্রামে পরিণত হয়। এই দিনের সঙ্গে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের মহান আত্মত্যাগের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে।

মে দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি

১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের সমাবেত হয়। ৫ লক্ষ শ্রমিকের তেজদীপ্ত আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ বেপরোয়া হামলা চালায় ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর।

পুলিশের গুলিতে শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় শিকাগোর রাজপথ। বুকের রক্ত ঢেলে, প্রাণ উৎসর্গ করে শ্রমিকরা। শ্রমিকরা ছিনিয়ে নিয়ে আসে তাদের ন্যায্য অধিকার, তাদের উপর হওয়া অত্যাচারের ন্যায্য অধিকার। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয় শ্রমিকের ৮ ঘন্টা কাজের দাবি।


শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে মে-কে ১৮৯০ সাল থেকে ' আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস ' হিসেবে পৃথিবীর মেহনতি মানুষ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করে আসছে। মে দিবস শ্রমিকের রক্ত ঢালা এক মহান আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক দিন।

শ্রমিকের পূর্বাবস্থা

ধনতান্ত্রিক শাসন কাঠামোতে শ্রমিকের রক্ত শোষণ করে মালিক শ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে।রুজির তাগিদে শ্রমিকের অত্যাচার বঞ্চনা সহ্য করে মালিকের কারখানায় কাজ করতে হতো। এ শ্রমের পরিমাণ ছিল দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা। এ অমানুষিক অত্যাচার ও শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে আমেরিকার শ্রমিকরা প্রথম আন্দোলন করে।

এ আন্দোলনের দাবি ছিল বেশ ঘণ্টা কাজের সীমাকে দশ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা। ১৮০৬ সালে কলকারখানায় দৈনিক কাজের সময় ছিল বিশ ঘন্টা। ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কর্ম ঘন্টা হ্রাস করার দাবিতে অনেক আন্দোলন ও ধর্মঘট হয়।


১৮৬২-৬৩ সালে শ্রমিকের দাবি আদায়ের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার'। ১৮৮৪ সালে এ শ্রমিক ফেডারেশনের চতুর্থ সম্মেলনে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এই সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, ১৮৮৬ সালের ১মে থেকে ৮ ঘণ্টাকেই দৈনিক কর্মপ্রহর হিসেবে আইনগত গণ্য করতে হবে। এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের জন্য পহেলা মে শিকাগোর রাজপথ শ্রমিকের রক্তের রঞ্জিত হয়।

পয়লা মে-র পরের ঘটনা

১৮৮৬ সালের পহেলা মে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। ৩ মে হারভেস্টার কারখানায় পুলিশের মামলায় ৬ জন নিরস্র শ্রমিক নিহত হয়। পরের দিন 'হে মার্কেট' স্কোয়ারে আবার সমবেত হয় শ্রমিকরা। তারা প্রতিবাদ জানায় পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে।

শ্রমিকের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় পতাকা। গ্রেফতার হন চারজন শ্রমিক নেতা। বিচারে তাদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে। এই অবিচারের বিরুদ্ধে সেচ্ছার হয়ে ওঠে গোটা বিশ্বের শ্রমিক সমাজ।

মে দিবসের তাৎপর্য

মে দিবস বিশ্বের সমস্ত শ্রমিকের সংগ্রাম,সংহতি ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক। মে দিবস মালিকের শোষণ বঞ্চনা ও অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের দিন। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ এ ঐতিহাসিক দিনে বুকের রক্ত ঢালা প্রতীকের রঞ্জিত লাল পতাকার তলে সমবেত হয়।

অশুভ চক্রের বিরুদ্ধে জ্বালায় স্বেচ্ছার প্রতিবাদ। সংগ্রামী চেতনায় মে দিবসে গোটা দুনিয়ার শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের জাগরণের দিন, শোষণমুক্তির অঙ্গীকারের দিন। মে দিবস এখন আর কেবল কয়েকজন শ্রমিকের আত্মদানের ঘটনা নয়। মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সারাবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা।


শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায্য দাবি আদায়ের দৃঢ় অঙ্গীকারে 'দুনিয়ার মজুদ এক হও'-এ সংগ্রামী স্লোগানে প্রতি বছর পহেলা মে গোটা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণী সংঘবদ্ধ হয়। সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের ঐক্য ও সংহতি তুলে ধরার উদ্দেশ্যই হলো পহেলা মে-কে 'মে-দিবস' হিসেবে উদযাপন করা হয়।

দেশে দেশে মে দিবস উদযাপনের ইতিবৃত্ত

১৮৮৯ সালের ১৪ ই জুলাই ফরাসি বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল প্যারিসে বাস্তিল দুর্গ পতনের শতবার্ষিক উদযাপিত হয়। প্রথম দিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাবে ১৮৯০ সাল থেকে পহেলা মে প্রতিবছর শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়।

প্যারিস সম্মেলনের পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালিত হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের ১ মে'র পরিবর্তে ৪ মে হাইড পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে মে দিবস পালিত হয়। আমেরিকায়ও ১৮৯০ সালে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস পালিত হয়।

মিছিল ওসমাবেশের মাধ্যমে ১৮৯০ সালে ফ্রান্সে মে দিবস উদযাপিত হয়। ১৮৯৬ সালে শ্রমিক ধর্মঘটের মাধ্যমে জার শাসিত রাশিয়ায় মে দিবস উদযাপিত হয়। চীনের প্রথম মে দিবস উদযাপিত হয় ১৯২৪ সালে। আজ বিশ্বের ছোট বড় প্রতিটি দেশ যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস উদযাপিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের মে দিবস

যন্ত্র সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গড়ে উঠেছে কলকারখানা। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে করে বিভিন্ন কলকারখানায়। মে দিবসের মহান চেতনাকে বুকে ধরে তারাও সমবেত হয় পহেলা তারিখে। গোটা বিশ্বের মেহনতি জনতার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকরাও সংহতি প্রকাশ করে।

স্বাধীনতা-পূর্বকালে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে মে দিবস পালন করতে পারেনি। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী মেহনতী মানুষের অধিকার কে স্বীকার করে নেন নি। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার দিতে তারা অস্বীকার করেন। কারণ তারা জানত শ্রমিকের হাতুড়ি নিঘোষেই ভেঙ্গে চুরমার হয় শাসকের সিংহাসন-তারাই বয়ে আনে মুক্তির সুপ্রভাত।


১৯৪৭ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত এ দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অশুভ তৎপরতা ও প্রতারণা সক্রিয় ছিল। ফলে এদেশের মেহনতি মানুষ মে দিবস যথাযোগ্য মর্যাদা সঙ্গে পালন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।

কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটলে এদেশের শ্রমিক শ্রেণী যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। শ্রমিক শ্রেণী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বাংলাদেশে প্রতিবছর  মে দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়ে থাকে।

লেখকের শেষ কথা

প্রিয় সম্মানিত পাঠক এই আর্টিকেলটি আপনাদের কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং আপনার বন্ধুদেরও জানার সুযোগ করে দিবেন।
* ধন্যবাদ*

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ওয়ার্ল্ডস টুয়েন্টিফোরের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url